পুরনো একখন্ড চাদরের নীচে মুড়িয়ে রাখা মানব সন্তানের নাম জহুরা। কতইবা বয়স। বিয়াল্লিশ কিংবা পয়তাল্লিশ। শরীর নামের খাঁচায় থাকা অচীন পাখিটা উড়াল দিয়েছে। নিথর নিস্তব্দ জহুরার দেহখানি পড়ে আছে। মানুষের বাসায় কাজ করতেন জহুরা। স্বামী আরেকটা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। তিন মেয়ে দুই ছেলের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার কঠিন দায়িত্বটি সামলেছেন সবার্ন্তকরণে। এর মধ্যে বড় ছেলেটার নেশার টাকার সংস্থান করতেও মাঝে মাঝে বাধ্য হতেন। চোখেমুখে দুঃখ বেদনার এক সমুদ্দুর জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার নাম আরাফাত। সাত বছর হবে বয়স। এই মা-ই আরাফাতের কাছে সব। এই কারণেই জহুরার পাশে দাঁড়িয়ে কেবলই ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে। মাকে ঘুম থেকে উঠার জন্য ডেকে যাচ্ছে সমানে। কিন্তু কই। মা তো আর উঠে না। মাকে ছুঁয়ে দেখছে। কিন্তু মা তো সাড়া দেন না। কেন মায়ের এমন আচরণ সেটা বুঝার বয়স আরাফাতের হয়েছে? এটাই যে জহুরার শেষ ঘুম, শেষ যাত্রা সেটা আরো পরে বুঝবে হয়তো। গত ৯ জানুয়ারি চমেক হাসপাতালের তিনতলার বারান্দায় জহুরা আর আরাফাতের সাথে দেখা। ছোট্ট এই ছেলেটি মায়ের সাড়াশব্দহীন দেহটা যেন পাহারা দিয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফিরোজ শাহ কলোনী থেকে আনা হয়েছে জহুরাকে। গলা ফু-লে গিয়েছিল তার। হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মাথায় মা-রা যান জহুরা। শরীরে আরো কত রোগ ছিল জানা নেই। গরীবদের রোগগুলো নির্ণয় করে চিকিৎসার সামর্থও নেই তাদের। বাস্তবতা বলছে, গরীবরা নিজেরাই এই সমাজের রোগ। তা না হলে কি জহুরাদের এভাবেই পড়ে থাকার কথা? তাদের জীবন এভাবে থমকে গেলে এই সমাজ কি থমকে দাঁড়াবে? কি দরকার? বেঁচে থাকতেও যেমন কানাকড়ি দাম নেই তাদের মা-রা যাওয়ার পরও তাই। ফিরোজ শাহ পর্যন্ত এতটুকুন পথ লা-শটা নিয়ে যেতে এ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার সংস্থান করতেই হাসপাতালের বারান্দায় এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা মুড়িয়ে থাকতে হয় জহুরাদের। সামনের নিঠোর ভবিষ্যৎ ও মা দুই সত্ত্বার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় আরাফাতের। ক্ষনে ক্ষনে মাকে ছুঁয়ে দেখা ছাড়া আর কিইবা করার আছে তার। এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া হয়তো কারো (নাম বললাম না) কল্যানে যোগাড় হলো কিন্তু আরাফাতের ভবিষ্যতের কান্ডারি কি যোগাড় হবে? জানি না। হয়তো হবে। হয়তোবা হবে না। এই অনিশ্চয়তার দোলনায় আরাফাতের ভবিষ্যতকে ভাসিয়ে তার খালাতো ভাইয়ের মোবাইল নম্বরটা শুধু নিয়ে আসলাম। বললাম তোমাদের সাথে শীঘ্রই আবার দেখা হবে।